মানিকগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে ধলেশ্বরী নদী খনন বিপাকে ফসলি জমির মালিকরা
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ধলেশ্বরী নদীতে অপরিকল্পিতভাবে নদী খননের পর নদী ভাঙ্গন রোধ, ফসলি জমি ও বসতবাড়ি রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন খনন কাজ বন্ধ করে দিলেও আবার শ্যালো মেশিন চালিত ড্রেজার লাগিয়ে পুরোদমে চলছে নদী খননের কাজ। সেই সাথে নদী তীরবর্তী ফসলি জমি থেকে অবাধে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে অনত্র বিক্রি করা হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। অসহায় হয়ে পড়েছে ফসলি জমির মালিকরা।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে, উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের চাড়াভাঙ্গা ঘাট এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, নদী তীরবর্তী এলাকায় ফসলি জমিতে চলছে মাটি কাটার মহোৎসব। নদী খননের সুযোগে প্রভাবশালীরা ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে টপ সয়েল নষ্ট করছেন। স্থানীয় কেউ এতে প্রতিবাদ কিংবা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। পাশাপাশি কারা এ মাটি কাটার সাথে জড়িত তাদের পরিচয়ও প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
ঘাটের উত্তর পাশে দেখা যায়, নদীতে শ্যালো মেশিন চালিত ড্রেজার বসিয়ে মাটি কেটে দক্ষিণ পাশের আলমগীরের মালিকানাধীন ৭৬ শতাংশ জমি ভরাট করা হচ্ছে। বিপরীতে ফুট প্রতি নেয়া হচ্ছে ৭ টাকা। একই কায়দায় বালু উত্তোলন করে পাশ্ববর্তী কালা মিয়ার প্রায় ১ বিঘা জমিও ভরাট করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নদীর সীমানা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে নদী তীরবর্তী ৩ ফসলি জমি থেকে এভাবে মাটি কেটে নেয়ায় আশপাশের জমির মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ইতিপূর্বে এভাবে মাটি কাটার ফলে গোলড়া এলাকার তীরবর্তী ফসলি জমি ভেঙ্গে পড়ে। ভাঙ্গনরোধে নদী খনন বন্ধ রাখা হলেও পুনরায় নদী তীরবর্তী ফসলি জমি থেকে শুরু হয়েছে মাটি কেটে বিক্রি।
চাড়াভাঙ্গা গ্রামের প্রবাসী কহিনুরের পুত্র শামীম অভিযোগ করে বলেন, আমাদের দেড় বিঘা ফসলি জমি থেকে জোর করে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। আমি ও আমার চাচা বাধা দিলে তারা উল্টো আমাদের হুমকি দিচ্ছে।
ওই গ্রামের আব্দুল মাজেদ খাঁন (৫২) বলেন, আমরা নদী তীরবর্তী জমির মালিকরা অসহায় হয়ে পড়েছি। কারো কাছে প্রতিকার চেয়ে ফল পাচ্ছি না। আমার নদী পাড়ের ৯ বিঘা ফসলি জমি নিয়ে আতংকে আছি। যে কোনো সময় ওই জমিতে ভেকু লাগিয়ে মাটি কেটে নেয়ার আশংকা করছেন তিনি। অনুরুপ অভিযোগ করেন ওই এলাকার আত্রব আলী (৭৫), মোয়াজ্জেম হোসেন(৫০)ও মিজানুর রহমানসহ অনেকেই।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. সোহরাব হোসেন বলেন, আমি একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধ করতে বিভিন্ন জায়গায় ধন্যা দিয়েও ফল পাচ্ছি না। নদী তীরবর্তী ফসলি জমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড পর্চা ও হাল নাগাদ খাজনা খারিজ থাকা সত্ত্বেও চর আজিমপুর গ্রামের হায়দার আলীর নেতৃত্বে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।
মাটি কাটার সাথে জড়িত মো. হায়দার আলী বলেন, এমপির কোঠায় আমজাদের ৭০০ মিটার ও বাসারের নামে ১ হাজার ২০০ মিটার নদী খননের কাজটি আমি করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীর সীমানা ২২০ ফুট ধরে কাটতে গিয়ে কিছু ফসলি জমি পড়েছে। এতে ওই জমির চাষাবাদকারীরা মেনে নিতে পারছেন না।
বায়রা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান জিন্নাহ লাঠু বলেন, খননের নামে ফসলি জমি থেকে মাটি বিক্রির বিষয়টি উপজেলা সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করা হয়েছিল। তার পরেও কিছুই হচ্ছে না। আমরা সকলেই অসহায়।
এ প্রসঙ্গে, পানি উন্নয়ন বোর্ড মানিকগঞ্জের প্রধান প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুনা লায়লা বলেন, ইউনিয়ন কমিটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সম্মতি ছাড়া কোনো ভাবেই নদী খনন কাজ করা যাবে না। আমাদের কাছে এখনো কোন অভিযোগ আসেনি। নদী তীরবর্তী ফসলি জমি থেকে যদি ইটভাটা কিংবা অন্য কোথাও মাটি বিক্রি করা হয়ে থাকে, সেটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, ধলেশ্বরী নদীতে খননের নামে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলণ করে কৃষি জমি ধ্বংশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও নদীর তীরে কৃষক বন্ধন করেছে কৃষক সমিতির নেতাকর্মীরা। ২৭ জানুয়ারি দুপুরে চারাভাঙ্গা এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে ঘন্টাব্যাপি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সিংগাইর উপজেলা কৃষক সমিতির সভাপতি আজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক আবিদ হোসেন, নির্বাহী সদস্য লাকী আক্তার, সিপিবির জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আবুল ইসলাম শিকদার, সহ-সাধারণ সম্পাদক আরশেদ আলী, কৃষক নেতা নাসির উদ্দিন, মুফতি আব্বাস উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম।
বক্তারা বলেন, ধলেশ্বরী নদী খননের নামে অসাধু ঠিকাদার নিয়মকানুন না মেনে নদীতে একই স্থানে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলণ করছে। ফলে নদীর পাড়ে কৃষি জমি ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতে শত শত একর কৃষি জমি নদীতে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের রেকর্ডকৃত জমিও রক্ষা পাচ্ছে না বালুখোরদের হাত থেকে। তারা নদীর পাড়ে কৃষি জমি খনন যন্ত্র দিয়ে কেটে নিচ্ছেন।
তারা দাবি জানান, নদী রক্ষা কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী নদী খনন করতে হবে । কমিশনের গাইডরাইন অনুযায়ী প্রস্থ্য ও দৈর্ঘ্য গভীরতা পরিমাপে নদী খনন করতে হবে এবং নদীর প্রবাহমান ধারা ধরে নদীর খনন করতে হবে ।
উল্লেখ্য, ৫জুলাই নিলামের মাধ্যমে আমজাদ হোসেন, আবু নঈম বাশার, দেওয়ান মাহবুবুল আলম ও আবুল কালাম আজাদ ২ কোটি ১১ লাখ ঘনফুট বালু ড্যাম্পিং স্পটের ও নদী খননকৃত মাটি সরবরাহের অনুমতি পান। এ সুযোগে নিলাম প্রাপ্ত ব্যক্তির বাইরে একাধিক প্রতিষ্ঠান অবাধে মাটি কেটে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এতে মাটি নেয়ার কাজে ব্যবহ্নত ট্রলিতে রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।